বাবুর্চি, রন্ধনশিল্পী এবং শেফ। Chef | Baburchi | Rondhon Shilpi

Chef Vs Baburchi vs Rondhon Shilpi

প্রথমে  বিখ্যাত একজন বাবুর্চি দেখি
বাবুর্চি, রন্ধনশিল্পী এবং শেফ।

হাজী রফিক বাবুর্চি - ফখরুদ্দিন বাবুর্চির ছেলে। উনাদের পারিবারিক বিখ্যাত খাবার প্রতিষ্ঠানের নাম - ফখরুদ্দিন বিরিয়ানি অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। ১৯৯৫ সালে ফখরুদ্দিন বাবুর্চি মারা যাবার পর তাঁর দুই ছেলে এই প্রতিষ্ঠান বেশ সুনামের চালাচ্ছেন। ঢাকায় ভিকারুননিসা নূন স্কুলের পাশে তাঁদের আদি কেন্দ্রটি ছাড়াও মগবাজার, গুলশান-১, ধানমন্ডি, মতিঝিল, বনানী ও উত্তরায় এবং চট্টগ্রামে রয়েছে এর শাখা। এ ছাড়া সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, দুবাইয় এবং লন্ডনেও ‘ফখরুদ্দিন বিরিয়ানি অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’-এর শাখা আছে।

এবার বিখ্যাত একজন রন্ধনশিল্পীঃ
রন্ধনশিল্পী কেকা ফেরদৌসী। বলা হয়ে থাকে, প্রতিদিনের রন্ধনকর্মকে দেশে শিল্পকর্মের সম্মান এনে দেয়ার পথিকৃৎ তিনি। এর মধ্যে ফ্রান্স থেকে পেয়েছেন ‘বেস্ট টিভি সেলিব্রেটি শেফ রেস্ট অব দ্যা ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল গুরমেন্ড ওয়ার্ল্ড কুক বুক এ্যাওয়ার্ড -২০১০’ এবং যুক্তরাজ্য থেকে পেয়েছেন ‘বৃটিশ কারি এ্যাওয়ার্ড- ২০১১’। আমার মতে সেলিব্রেটি রন্ধনশিল্পী হবার জন্য প্রয়োজন কিছু মিডিয়া সাপোর্ট, যা উনার রয়েছে। তিনি বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের মেয়ে। উনার স্বামী মুকিত মজুমদার বাবু ইমপ্রেস গ্রুপের পরিচালক। ফলে চ্যানেল আইয়ে রান্না বিষয় অনুষ্ঠানে তিনি একজন পরিচিত মুখ।

এবং একজন বিখ্যাত শেফঃ
মিস্টার টনি খান, বিখ্যাত শেফ। দেশ বিদেশের বিভিন্ন নামকরা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছেন। দেশে ফিরে কাজ করেছেন র‍্যাডিসন ব্লু ওয়াটার গার্ডেন, ওয়েস্টিন এবং গ্র্যান্ড সুলতান টি রিজোর্টে। একজন সত্যিকারের সেলিব্রেটি শেফ। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে তিনি নিয়মিত রান্নার অনুষ্ঠান করেন। সম্প্রতি তিনি একটি রান্নার স্কুলও দিয়েছেন।


যাইহোক, লেখার শুরুতে বলেছিলাম একই পেশার তিনটি ভিন্ন নামকরন সম্পর্কে। আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি, একই পেশার ভিন্ন ভিন্ন নাম কেন দেয়া হয়? কারা দেয় এই নাম? যদি আমরা একটু বিশ্লেষন করতে যাই তাহলে বলতে হবে, আমাদের দেশে কাজের মুল্যায়নে জাত ও শ্রেণী চেতনা চোখে পড়ার মত। যার মূলে রয়েছে বাঙালি হিন্দু সমাজের বহুল কথিত জাতের শ্রেনী বিভাজনের প্রভাব। আমাদের দেশে হিন্দু মুসলমানরা যুগ যুগ ধরে পারস্পরিক সৌহার্দ্য বজায় রেখে বসবাস করছে। বাঙালি মুসলমান সমাজের একটি বড় সময় নিয়ন্ত্রিত হয়েছে হিন্দু সমাজের এই শ্রেনী বিভাজনের আলোকে। হিন্দু মুসলমানের যৌথ সমাজ যখন জমিদার ও নবাবদের প্রভাবমুক্ত হলো এবং ধর্মীয় বিভাজনের প্রেক্ষাপট যতদিনে ধীরে ধীরে বিলীন হলো, ততদিনে আমাদের রক্তে ঢুকে গিয়েছে সামন্তবাদী মনোভাব, আমরা শিখে গিয়েছি সমাজের দরিদ্রতম অংশকে নিপীড়ন, অবহেলা আর অবজ্ঞাই সমাজে নিজেদেরকে প্রভাবশালী ও সম্মানিত হিসেবে মূল্যায়নের চাবিকাঠি। সেই চলমান ধারা থেকেই আমাদের দেশে কাজের উঁচু নিচু শ্রেনীবিভাগ। উদহারন স্বরুপ বলা যায়, এখনও অনেক মানুষ রাস্তায় রিকশাওয়ালা, মুচি, হোটেল বয়, বাসের হেল্পার ইত্যাদি পেশার মানুষকে তুই তুকারী করেন। বিষয়টা আমাদের সমাজে এতই স্বাভাবিক যে, অনেক তরুনও একজন বৃদ্ধ রিকশাওয়ালাকে অবলীলায় তুমি বলে সম্বোধন করেন।

বাংলাদেশের রান্নাঘর থেকে বিশ্বদরবারে: বাবুর্চি, রন্ধনশিল্পী নাকি শেফ?

বাবুর্চি শব্দের অর্থ মুসলমান পাচক বা পুরুষ পাচক। অর্থাৎ, দেশের মধ‍্যে মুসলমান পাচক বা পুরুষ পাচককে এককথায় বাবুর্চি বলে।

সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী বা অন‍্যান‍্য নামী-দামী প্রতিষ্ঠানে কুক, কুকি বা শেফ পদ থাকে। 

পক্ষান্তরে, দেশের মধ‍্যে বিয়ে বাড়ীর অনুষ্ঠান বা অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে, বাবুর্চি থাকে, যারা সাধারণ অনুষ্ঠানে আগত মানুষদের জন‍্য রান্না-বান্না করে।

  • হাজী রফিক বাবুর্চি (ফখরুদ্দিন বিরিয়ানি অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট): ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ফ্যামিলি বিজনেস আজ সিঙ্গাপুর, লন্ডন, দুবাইয়েও থিম্বস ফুড লাভারদের। কিন্তু প্রতিষ্ঠাতার উত্তরসূরিরা এখনও "বাবুর্চি" টাইটেলই ধরে রেখেছেন, যা ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা।

  • রন্ধনশিল্পী কেকা ফেরদৌসী: ফ্রান্স-যুক্তরাজ্যের অ্যাওয়ার্ডজয়ী এই শেফ টেলিভিশনে রান্নাকে এন্টারটেইনমেন্টে পরিণত করেছেন। তাঁর স্টাইল—মিডিয়া সেলিব্রিটি হওয়ার পথ দেখিয়েছে হাজার নারীকে।

  • শেফ টনি খান: গ্লোবাল হসপিটালিটি চেইনে কাজ করা এই সেলেব শেফ এখন "টনি’স কুলিনারি স্কুল" চালু করে নতুন প্রজন্মকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।


২০২৩-এ বাংলাদেশের ফুড ইন্ডাস্ট্রি: ডিজিটাল রেভোলিউশন ও নতুন আইকন

১. সোশ্যাল মিডিয়া স্টার শেফরা:

  • শেফ ডলি চৌধুরী: ২ মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবারের YouTube চ্যানেল "Dolly’s Kitchen" দেশ-বিদেশে বাংলা রেসিপি ছড়াচ্ছে। তাঁর হাত ধরে ঘরে বসেই মানুষ শিখছে স্পেশালিটি কফি থেকে সুশি বানানো!

  • শেফ জাহেদ : ফেসবুকে "Bangladeshi Proffesional chef" গ্রুপে ৫০ হাজার সদস্য। ও ভিবিন্ন ধরনের এক্টিভিটি।

২. মহিলা শেফদের উত্থান:

  • শেফ নাজিয়া রহমান: "Grand Chef Bangladesh" প্রতিযোগিতার জজ এবং "নাজিয়া’স ফিউশন কিচেন" এর প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর রেসিপি বই "Spice & Soul" অ্যামাজনে বেস্টসেলার।

  • শেফ তানজিনা তাসনিম: লন্ডনের মিশেলিন স্টার রেস্তোরাঁ "The Clove Club" এ কাজ করা প্রথম বাংলাদেশি নারী।

৩. ফুড টেক স্টার্টআপ:

  • "পথের পিঠা" (Pathor Pitha): ঢাকার প্রথম আর্টিসানাল পিঠা ডেলিভারি সার্ভিস, যারা গাজরের হালুয়া থেকে তিলের নারকেল পিঠা বিক্রি করে মাসে ২০ লাখ টাকা আয় করছে!

  • "SpiceCraft": AI ব্যবহার করে ব্যক্তিগত রেসিপি জেনারেট করে—মাত্র ৫ মিনিটে আপনার টেস্ট বুঝে সুপারিশ করবে মাছের রান্না নাকি বিরিয়ানি!


কেন এখনও "বাবুর্চি" শব্দে অসম্মান?

সমাজের মনোজগতে এখনও কাজকে "উচ্চ" বা "নিম্ন" শিল্পে ভাগ করা হয়। যেমন:

  • পড়াশোনা vs হাতে-কলমে কাজ: একজন ইঞ্জিনিয়ারকে "স্যার" ডাকা হলেও শেফ টনি খানকে অনেকে "ভাইয়া" বলে ডাকে—পেশার প্রতি শ্রদ্ধার অভাব।

  • জেন্ডার বায়াস: রান্নাকে এখনও "নারীদের কাজ" মনে করা হয়। পুরুষ শেফরা মিডিয়ায় সেলিব্রিটি হলেও বাড়িতে রান্না করা নারীরা "গৃহিণী" হিসেবেই পরিচিত।

কেস স্টাডি:

  • শেফ রেজাউল করিম (রিকশাচালক থেকে শেফ): দিনে রিকশা চালিয়ে, রাতে YouTube দেখে রান্না শিখে আজ তিনি চট্টগ্রামের "Spice Route" রেস্তোরাঁর হেড শেফ!

  • "Cloud Kitchen" বিপ্লব: করোনাকালে বাড়ির রান্নাকে ব্যবসায়িক রূপ দিয়েছে হাজার নারী। ফেসবুকে "মা কিচেন", "বোনের হাতের স্বাদ"—এগুলো মাসে ৫০-১০০ হাজার টাকা আয় করছে!


সমাধানের পথ: কীভাবে বদলাবে সমাজ?

১. এডুকেশন রিফর্ম:

  • বাংলাদেশ ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ইনস্টিটিউট এখন ডিপ্লোমা ইন "কুলিনারি আর্টস" অফার করে। ভর্তি হওয়া ছাত্রদের ৪০% নারী!

  • "Foodpanda অ্যাকাডেমি" চালু করেছে ফ্রি কোর্স—যেকোনো বয়সী মানুষ শিখতে পারবেন প্রফেশনাল কুকিং।

২. মিডিয়া রিপ্রেজেন্টেশন:

  • চ্যানেল আই-এর "রান্না ঘর" বা নাগরিক টিভির "Master Chef Bangladesh" দেখিয়ে দিচ্ছে—রান্না প্রতিযোগিতা ক্যারিয়ার!

  • Netflix-এ আসছে ডকু-সিরিজ "বাংলার স্বাদ: From Street to Fine Dining", যেখানে শেফরা বলবেন সংগ্রামের গল্প।

৩. যুবাদের মাইন্ডসেট বদল:

  • "Food Bloggers Association of Bangladesh" (FBAB) এর মতে, ২০২৩-এ ১০,০০০+ তরুণ-তরুণী ফুড কন্টেন্ট ক্রিয়েটর হিসেবে সক্রিয়।

  • "Home Chef" অ্যাপে এখন ৩,০০০+ হোম কুক রেজিস্টার্ড—যারা বাড়ি বসে তৈরি করছেন গরম ভাত, মাছের কালিয়া, এমনকি ক্রিমি পাস্তা!


চ্যালেঞ্জ vs সম্ভাবনা:

  • চ্যালেঞ্জ:

    • ৭০% রেস্তোরাঁ এখনও "শেফ" নয়, "বাবুর্চি" নিয়োগ দেয়—বেতন ১৫-২০ হাজার টাকা।

    • মসলার দাম বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আর্টিসানাল ফুড বিজনেস।

  • সুযোগ:

    • বিশ্বজুড়ে "হালাল ফুড মার্কেট" ২০২৫ সাল নাগাদ ১.৯ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়াবে। বাংলাদেশের "হালাল ক্যাটারিং" সার্ভিসগুলো এখন মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপে এক্সপোর্ট করছে।

    • সরকারি প্রকল্প "একটি গ্রাম একটি পণ্য" (One Village One Product) এর অধীনে স্থানীয় খাবারকে গ্লোবাল ব্র্যান্ড বানানো হচ্ছে—যেমন: কুমিল্লার রসমালাই, সিলেটের সাতকরা।

"বাবুর্চি", "রন্ধনশিল্পী" বা "শেফ"—নামে নয়, কাজের গুণে সম্মান। বাংলাদেশের ফুড ইন্ডাস্ট্রি আজ ২০ বিলিয়ন ডলারের মার্কেট, যেখানে প্রতিদিন জয় করছে নতুন স্বপ্ন। কেকা ফেরদৌসী, টনি খান, ডলির মতো মানুষরা প্রমাণ করেছেন—রান্না শুধু পেট ভরার মাধ্যম নয়, এটি অর্থ, সম্মান ও শিল্পের সংমিশ্রণ। আপনার প্লেটে যে খাবারটি আছে, সেটি হয়তো কোনো তরুণের সিলিকন ভ্যালি যাওয়ার টিকেট! কাজেই, পরেরবার কোনো "বাবুর্চি"কে দেখলে শুধু খাবার অর্ডার নয়, জিজ্ঞাসা করুন তাঁর গল্প—সমাজ বদলের শুরু সেখান থেকেই। 

মানুষগুলো কর্মজীবন আমাদেরকে এটাই শেখায় আপনি যে কাজই করেন না কেন, তা ভালোবেসে করতে হবে। পৃথিবীর কোন কাজই ছোট নয় বরং কর্মবিমুখিতাই ছোট। কিছুদিন আগে ফেসবুকের একটি গ্রুপে দেখলাম জনৈক কিশোর ৫০০০ টাকায় কোন ব্যবসা শুরু করতে চাইছেন। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, অধিকাংশ মানুষই তাঁর এই প্রচেষ্টাকে হাস্যকর হিসেবে দেখছেন, নানারকম নেতিবাচক কথায় তাঁর এই উদ্যোগকে পিছিয়ে দিতে চাইছেন। হাতে গনা অল্প কয়েকজন মানুষ তাকে ইতিবাচক পরামর্শ দিয়েছেন। তাকে বললাম, ভাইয়া, মন খারাপ করবেন না। সবার মাঝে যদি ছোট ছোট প্রচেষ্টাকে উৎসাহ দেয়ার প্রবণতা থাকত, তাহলে এই সমাজ সফল মানুষদের ভীড়ে কোলাহল মুখর থাকত। অথচ বাস্তবে সবাই সফল হয় না, কারন সবাই চেষ্টা করে না। যারা সকল প্রতিকুলতা দূরে ঠেলে সামনে এগিয়ে যায়, তারাই সফল হয়। 

Chef Jahed

https://web.facebook.com/ChefJahed.bd

Post a Comment

Previous Post Next Post