খিচুড়ি রান্নার রেসিপি |
খিচুড়ির ইতিহাস
খিচুড়ি, বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয় খাবার, যার নাম শুনলেই সাধারণত সাদাসিধে, স্বাস্থ্যকর এবং সহজে প্রস্তুত করা যায় এমন একটি খাবারের কথা মনে আসে। যদিও এটি আজকাল বিভিন্ন ধরনের উপকরণ দিয়ে প্রস্তুত করা হয়, তার মূল উৎস, উপকরণ এবং প্রস্তুত প্রণালী শুরুর দিকে ছিল অনেক সাদামাটা। তবে, খিচুড়ির ইতিহাস অনেক পুরনো এবং এটি প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার হিসেবে পরিচিত।
খিচুড়ির উৎপত্তি:
খিচুড়ি মূলত ভারতীয় উপমহাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার, যা প্রাচীনকাল থেকে প্রস্তুত হয়ে আসছে। "খিচুড়ি" শব্দটি সংস্কৃত শব্দ "খিচর" থেকে এসেছে, যার অর্থ হচ্ছে মিশ্রিত বা ভেঙে ফেলা। এটি মূলত চাউল (ভাত) এবং ডাল (মুগ ডাল বা অন্যান্য ডাল) মিশিয়ে রান্না করা হয়। মুঘল যুগে এই খাবারটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, এবং তাদের রান্নার পদ্ধতি ও উপকরণে বেশ কিছু পরিবর্তন আসে। খিচুড়ির রান্নার পদ্ধতি অনেক সময় মাংস বা অন্যান্য মশলা দিয়ে পরিবেশন করা হত, যা একে আরও স্বাদযুক্ত এবং রুচিকর করে তোলে।
বাংলাদেশে খিচুড়ির ইতিহাস:
বাংলাদেশে খিচুড়ির জনপ্রিয়তা অত্যন্ত পুরনো এবং বিভিন্ন সংস্কৃতির সংমিশ্রণে এটি আজকের দিনে একটি অতি পরিচিত খাবার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটি একটি সহজ, স্বাস্থ্যকর এবং পুষ্টিকর খাবার, যা গৃহস্থালির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। খিচুড়ি সাধারণত বৃষ্টির দিন, বিশেষ উৎসব, পিকনিক বা বড় কোনো উপলক্ষে পরিবেশন করা হয়।
খিচুড়ির এক বিশেষ আকর্ষণ হলো এর সহজ প্রস্তুতি এবং পুষ্টিগুণ। মূলত গরুর মাংস, মুরগি, বা শুঁটকি মাছ দিয়ে এটি রান্না করা হয়ে থাকে। এছাড়া, ভেজিটেবল খিচুড়িও বেশ জনপ্রিয়, যেখানে মটরশুঁটি, গাজর, মিষ্টি আলু, বা অন্যান্য শাকসবজি মিশিয়ে রান্না করা হয়।
ঐতিহ্যগত খিচুড়ি:
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খিচুড়ির ভিন্ন ভিন্ন ধরন রয়েছে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের কিছু অংশে "মাটির হাঁড়িতে খিচুড়ি" জনপ্রিয়। এতে মাটির হাঁড়ি ব্যবহৃত হওয়ার কারণে খাবারটির স্বাদ ও গন্ধ একধরনের বিশেষ আকর্ষণ সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের খিচুড়ির রান্নায় সাধারণত চিরাচরিত মসলার পাশাপাশি তেল ও ঘি, মাংস বা মুরগি, ডাল, আলু এবং মিষ্টি মশলা ব্যবহার করা হয়।
উৎসব এবং খিচুড়ি:
বাংলাদেশে খিচুড়ি বিশেষ দিনগুলিতে যেমন ঈদ, পয়লা বৈশাখ, বা বড় কোনো পারিবারিক অনুষ্ঠানে অন্যতম জনপ্রিয় খাবার হিসেবে পরিবেশন করা হয়। বিশেষ করে ঈদের দিন খিচুড়ি ও মাংস (গরু বা মুরগি) দিয়ে এক বিশেষ ডিশ হিসেবে পরিবেশন করা হয়।
আধুনিক খিচুড়ি:
আজকাল খিচুড়ি শুধু ঘরোয়াই নয়, অনেক রেস্টুরেন্ট এবং ক্যাফেতেও পাওয়া যায়। বিভিন্ন ধরনের খিচুড়ি যেমন, ভেজিটেবল খিচুড়ি, মাংসের খিচুড়ি, শুঁটকি মাছের খিচুড়ি ইত্যাদি এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আধুনিক রান্নার পদ্ধতিতে দ্রুত এবং সহজ পদ্ধতিতে খিচুড়ি তৈরি করার জন্য বিভিন্ন কুকিং টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব:
খিচুড়ি শুধু খাদ্য নয়, এটি বাংলাদেশের অনেক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। এটি সাধারণত অতিথিদের আপ্যায়ন করার জন্য পরিবেশন করা হয় এবং বড় পারিবারিক অনুষ্ঠান বা বন্ধুদের সঙ্গে বসে খাওয়ার জন্য একটি আদর্শ খাবার হিসেবে বিবেচিত হয়।
খিচুড়ির ইতিহাস বাংলাদেশের খাবার সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, যা প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক সময় পর্যন্ত জনগণের মধ্যে জনপ্রিয়তা বজায় রেখেছে। এর সহজলভ্যতা, স্বাস্থ্যকর উপাদান এবং পুষ্টিকরতা এটিকে বাংলাদেশের খাদ্য তালিকায় একটি অমূল্য স্থান দিয়েছে।
১. গরুর মাংসের ভুনা খিচুড়ি
প্রয়োজনীয় উপকরণ:
- গরুর মাংস: ১ কেজি (চর্বিছাড়া মাংস হাড়সহ ছোট করে কাটা)
- যে কোন সুগন্ধি চাল: আধা কেজি
- মুগ ডাল: ১ কাপ
- মসুর ডাল: ১ কাপ
- লবণ: স্বাদমতো
- মরিচ গুঁড়া: ১ টেবিল চামচ (ঝাল কম খেলে কমিয়ে দিতে হবে)
- হলুদ গুঁড়া: দেড় চা চামচ
- ধনিয়ার গুঁড়া: ১ চা চামচ
- জিরার গুঁড়া: ১ চা চামচ
- গরম মশলার গুড়া: আধা চা চামচ
- রসুন বাটা: ১ টেবিল চামচ
- আদা বাটা: ১ টেবিল চামচ
- সরিষার তেল: ১ টেবিল চামচ
- লেবুর রস: ১ চা চামচ (এটা অপশনাল)
- দারুচিনি: ২/৩ টুকরা
- সাদা/সবুজ এলাচ: ৩/৪টি
- লবঙ্গ ও গোলমরিচ: ৩/৪টি
- কালো এলাচ: ১টি
- তেজপাতা: ২টি
- পেঁয়াজ কুচি: দেড় কাপ
- তেল: দেড় কাপ
- ঘি: ২ টেবিল চামচ (না দিলেও চলবে)
প্রস্তুত প্রণালী:
- প্রথমে মাংস ভাল করে ধুয়ে নিন।
- ধোয়া মাংসে সব গুড়া ও বাটা মশলা, সরিষার তেল এবং এক চামচ লেবুর রস দিয়ে ভাল করে মাখিয়ে নিয়ে ১০ মিনিট অপেক্ষা করুন।
- মুগ ডাল তাওয়ার টেলে/ভেজে নিতে হবে। এরপর মসুর ডাল, চাল ও টেলে নেওয়া ডাল সব একসাথে ভাল করে ধুয়ে পানি ঝরানোর জন্য কিছুক্ষণ একপাশে রেখে দিন।
- চুলায় প্যান বসিয়ে সয়াবিন তেল দিয়ে তাতে সব গোটা মশলা ও পেয়াজ ভেজে নিয়ে মাখিয়ে রাখা মাংস দিয়ে মাঝারি আঁচে ঢেকে রান্না করতে হবে ১০ মিনিট।
- ১০ মিনিট পর ঢাকনা তুলে ভাল করে মাংস কষিয়ে নিতে হবে। কষাতে কষাতে পানি শুকিয়ে গেলে ১ কাপ পানি দিয়ে আধা ঘণ্টা প্যান ঢেকে রান্না করতে হবে।
- মাংস প্রায় সেদ্ধ হয়ে গেলে ধুয়ে রাখা চাল ঢেলে দিন। মাঝারি আঁচে ৭/৮ মিনিট মাংস সহ চাল ডাল ভাল করে মিশিয়ে নিতে হবে।
- তারপর ১০ কাপ পানি দিয়ে ভাল করে নেড়ে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে উচ্চতাপে ৮/১০ মিনিটের মতো রান্না করতে হবে। বলক উঠলে নেড়ে ২০ মিনিটের মতো একদম কম আঁচে রান্না করতে হবে।
- ঢাকনা তুলে ঘি দিয়ে আলতো হাতে নেড়ে ৫ মিনিট দমে রেখে গরম গরম পরিবেশন করতে হবে বিফ ভুনা খিচুড়ি।
২. মিক্সড ডালের/পাঁচমিশালি ডালের ভুনা খিচুড়ি
প্রয়োজনীয় উপকরণ:
- যে কোন সুগন্ধি চাল: ২ কাপ (২৫০ গ্রাম মাপের কাপ)
- মসুর ডাল: ১ মুষ্টি
- মুগ ডাল: ১ মুষ্টি (ভেজে নিতে হবে)
- বুটের ডাল: ১ মুষ্টি (৩/৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে)
- খেসারি ডাল: ১ মুষ্টি
- মাসকালাইয়ের ডাল: ১ মুষ্টি (ভেজে নিতে হবে)
- লবণ: স্বাদমতো
- মরিচ গুঁড়া: ২ চা চামচ (ঝাল কম খেলে কমিয়ে দিতে হবে)
- হলুদ গুঁড়া: আধা চা চামচ
- ধনিয়ার গুঁড়া: ১ চা চামচ
- জিরার গুঁড়া: ১ চা চামচ
- গরম মশলার গুড়া: আধা চা চামচ
- রসুন বাটা: ১ চা চামচ
- আদা বাটা: ১ চা চামচ
- কাঁচা মরিচ: ৬/৭টি (মাঝ দিয়ে অল্প চিরে নিতে হবে)
- দারুচিনি: ২ টুকরা
- সাদা/সবুজ এলাচ: ২টি
- লবঙ্গ ও গোলমরিচ: ৩/৪টি করে
- তেজপাতা: ১টি
- পেঁয়াজ কুচি: ১ কাপ
- তেল: ১ কাপ
- ঘি: ১ টেবিল চামচ (না থাকলে তেলের পরিমাণ বাড়িয়ে নিতে হবে)
প্রস্তুত প্রণালী:
- প্রথমে ৩ ঘণ্টা আগে ভিজিয়ে রাখা বুটের ডালের মাঝে বাকি সব ডাল দিয়ে আরো ৩০ মিনিট ভিজিয়ে রাখতে হবে।
- ৩০ মিনিট পর ডালের সাথে চাল মিশিয়ে ভাল করে ধুয়ে চালনি/ঝাঝরি তে রেখে দিতে হবে পানি ঝড়ানোর জন্য।
- চুলায় কড়াইয়ে তেল দিয়ে তাতে এলাচ, দারুচিনি, গোলমরিচ, তেজপাতা, লবঙ্গ দিয়ে ২০/৩০ সেকেন্ড নেড়ে তাতে পেয়াজ কুচি দিয়ে ভাজতে হবে।
- পেয়াজ ব্রাউন কালার হয়ে আসলে এতে আদা বাটা, রসুন বাটা, মরিচ গুঁড়া, লবণ, হলুদ ও এক কাপ পানি দিয়ে মশলা গুলো কষিয়ে নিতে হবে।
- মশলা থেকে তেল ছেড়ে আসলে তাতে ধুয়ে রাখা চাল ডাল ও কাঁচা মরিচ দিয়ে ৬ মিনিট ভাজতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যেনো লেগে/পুড়ে না যায়।
- ভাজা হয়ে গেলে চাল ডালের দ্বিগুন পানি অর্থাৎ ৬ কাপ পানি দিয়ে চুলার তাপ বাড়িয়ে বলক ওঠা পর্যন্ত ঢেকে রান্না করতে হবে।
- বলক উঠলে চুলার তাপ কমিয়ে ঢাকনা খুলে ভাল করে নেড়ে লবন চেক করে ৫ মিনিট রান্না করতে হবে।
- ৫ মিনিট পর ঢাকনা তুলে আলতো করে নেড়ে দিয়ে চুলার আঁচ কমে রেখে ১০ মিনিট রান্না করতে হবে।
- ১০ মিনিট পর উপরে ঘি ছড়িয়ে ৪/৫ মিনিট ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দমে রাখতে হবে। দম দিয়ে পরিবেশন করতে হবে গরম গরম।
৩. নিরামিষ ভোগের খিচুড়ি
প্রয়োজনীয় উপকরণ:
- মুগ ডাল: ২৫০ গ্রাম
- গোবিন্দভোগ চাল: ২৫০ গ্রাম
- আলু বড়: ২টি (মাঝারি টুকরো করে কাটা)
- ফুলকপি: ২ কাপ (মাঝারি টুকরো করে কাটা)
- বড় সাইজের টমেটো: ১টা (চার টুকরো করে কাটা)
- মটরশুঁটি: ১ কাপ
- গোটা জিরা: ১ চা চামচ
- এলাচ: ৩টি
- দারুচিনি: ½ টুকরো
- লবঙ্গ: ৩টি
- শুকনো মরিচ: ৩টি
- তেজপাতা: ২/৩টি
- আদা বাটা: ২ চা চামচ
- নারকেল কোরা: ২ টেবিল চামচ
- হলুদ গুঁড়া: আধা চা চামচ
- জিরা গুঁড়া: ১ চা চামচ
- লবণ: ২ চা চামচ বা স্বাদমতো
- চিনি: ১ চা চামচ
- কাঁচা মরিচ: ৫/৬টি
- ঘি: ১ টেবিল চামচ
- গরম মশলা গুঁড়া: ½ চা চামচ
- সয়াবিন তেল: ১ কাপ
- সরিষার তেল: ১ কাপ
- গরম পানি: ১.৮ লিটার
প্রস্তুত প্রণালী:
- প্রথমে চাল ভালো করে ধুয়ে পানি ঝরাতে দিন।
- চুলায় কড়াই বসিয়ে গরম করে মাঝারি আঁচে মুগ ডাল ভেঁজে/টেলে নিন।
- এক পাত্রে আদা বাটা, হলুদ গুঁড়া ও জিরা গুঁড়া এক কাপ পানিতে মিশিয়ে নিতে হবে।
- তেল গরম হলে তাতে শুকনা মরিচ, তেজপাতা, এলাচ, দারুচিনি, গোলমরিচ ও জিরা দিয়ে গন্ধ বের হতে দিন।
- এবার এতে আলু, ফুলকপি, টমেটো ও মটরশুঁটি যোগ করুন।
- ১০ মিনিট পর ডাল ও চাল ঢেলে দিন, ভালো করে মেশান।
- পানি ঢেলে দিন, একে একে সমস্ত মশলা এবং ঘি যোগ করে ঢাকনা দিন।
- খিচুড়ি তৈরি হলে গরম গরম পরিবেশন করুন।