ভিটামিন কাকে বলে? কত প্রকার? What is Vitamin and their types ?

ভিটামিন কাকে বলে? ভিটামিন কত প্রকার এবং কি কি?

বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বিজ্ঞানীগণ প্রমাণ করেছেন যে, খাদ্যে শর্করা, আমিষ, স্নেহ পদার্থ, খনিজ লবণ ছাড়াও আরও কতগুলো সূক্ষ্ম উপাদানের প্রয়োজন। এর অভাবে শরীর নানা রোগে (যেমন- রাতকানা, বেরিবেরি, স্কার্ভি ইত্যাদি) আক্রান্ত হয়। ভিটামিন বলতে আমরা খাদ্যের ঐ সব জৈব রাসায়নিক পদার্থকে বুঝি যা খাদ্যে সামান্য পরিমাণে উপস্থিত থাকে। ভিটামিনসমূহ প্রত্যক্ষভাবে দেহ গঠনে অংশগ্রহণ না করলেও এদের অভাবে দেহের ক্ষয়পূরণ, বৃদ্ধিসাধন বা তাপশক্তি উৎপাদন ইত্যাদি বিভিন্ন ক্রিয়াগুলো সুসম্পন্ন হতে পারে না।

ভিটামিনের প্রকারভেদ : দ্রবণীয়তার গুণ অনুসারে ভিটামিনকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-

  • ১. স্নেহ জাতীয় পদার্থে দ্রবণীয় ভিটামিন, যেমন- এ, ডি, ই, এবং কে। 
  • ২. পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিন, যেমন- ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স এবং সি।

ভিটামিনের উৎস : গাছের সবুজ পাতা, কচি ডগা, হলুদ ও সবুজ বর্ণের সবজি, ফল ও বীজ ইত্যাদি অংশে ভিটামিন থাকে।

ভিটামিন কাকে বলে? এটি কত প্রকার এবং কি কি?
ভিটামিন কাকে বলে? এটি কত প্রকার এবং কি কি?


ভিটামিন এ (Vitamin A)

ভিটামিন এ হলো একটি Fat Soluble ভিটামিন যা স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, প্রজনন স্বাস্থ্য এবং শারীরিক বৃদ্ধি ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও এটি হৃদপিণ্ড, ফুসফুস ও অন্যান্য অঙ্গসমূহ সঠিকভাবে কাজ করতে সহায়তা করে। 

এটি প্রাকৃতিকভাবে অনেক ধরনের খাবারে পাওয়া যায় যা গ্রহণ করলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা যেমন চুল পড়া, ত্বকের সমস্যা, চোখের শুষ্কতার সমস্যা, রাতকানা ইত্যাদি থেকে মুক্ত থাকা যায়।

Vitamin A এর ​​দুটি প্রাথমিক রূপ রয়েছে: 

  • Pre-Formed Vitamin A or Retinol & retinyl esters  (প্রিফর্মড ভিটামিন এ বা রেটিনল এবং রেটিনাইল এস্টার)
  • Pro-vitamin A Carotenoid (প্রোভিটামিন এ ক্যারোটিনয়েড)

প্রোভিটামিন A এর সবচেয়ে সাধারণ রূপ হল বিটা-ক্যারোটিন, তবে অন্যান্য রূপও রয়েছে যেমন আলফা-ক্যারোটিন এবং গামা-ক্যারোটিন। এই ক্যারোটিনয়েড গুলো শরীরে Vitamin A তে রূপান্তরিত হয়। 

ভিটামিন এ এর উৎস:

অনেক ধরনের প্রাকৃতিক উৎস আছে যেখান থেকে উভয় ধরনের প্রোভিটামিন এ এবং প্রিফর্মড ভিটামিন এ পাওয়া যায়। তবে প্রোভিটামিন এ এর তুলনায় প্রিফর্মড ভিটামিন এ আমাদের শরীর সহজে শোষণ এবং ব্যবহার করতে পারে। 

প্রোভিটামিন এ (beta-carotene) এর সবচেয়ে ভালো উৎস গুলো হলো উদ্ভিদ-ভিত্তিক খাবার যেমন: 

গাজর,মিষ্টি আলু,পালং শাক,বাঁধাকপি, ব্রকলি,সরিষা শাক,ক্যাপসিকাম বা বেল পেপার,টমেটো ,কুমড়া, লেটুস, আম, জাম্বুরা,পাকা পেঁপে ইত্যাদি 

প্রিফর্মড ভিটামিন এ এর সবচেয়ে ভালো উৎস গুলো হলো:

গরু ও মুরগীর কলিজা,ডিমের কুসুম,কড লিভার অয়েল,দুধ এবং ইয়োগার্ট,মাখন,চিজ বা পনির ,স্যামন মাছ (Salmon Fish),ছোট মাছ যেমন: মলা ও ঢেলা, মাখন ইত্যাদি তে

এছাড়াও সিরিয়াল, মার্জারিন এবং দুধের মতো পুষ্টিকর খাবারগুলোও এই ভিটামিন এর ভালো উৎস।


ভিটামিন এ এর ​​কাজ:

এই ভিটামিন শরীরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্রিয়াকলাপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যার মধ্যে রয়েছে:

স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি: এটি রেটিনার স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। রেটিনায় ভিজ্যুয়াল পিগমেন্ট তৈরির জন্য Vitamin A প্রয়োজনীয়, যা সঠিক দৃষ্টিশক্তির জন্য অপরিহার্য, বিশেষ করে কম আলোতে।

ত্বকের স্বাস্থ্য: এই ভিটামিন কোষের টার্নওভার প্রচার করে এবং প্রদাহ কমিয়ে সুস্থ ত্বক বজায় রাখতে সাহায্য করে।

ইমিউন সিস্টেম:   Vitamin A একটি সুস্থ ইমিউন সিস্টেমের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি শ্বেত রক্তকণিকা তৈরীর মাধ্যমে ইমিউন সিস্টেমের সঠিক কার্যকারিতা বজায় রাখে। ইমিউন কোষের উত্পাদন এবং কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে, যা সংক্রমণ এবং বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করতে পারে।

ভিটামিন এর উপকারিতা: 

অন্যদিকে, এই ভিটামিন পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্রহণ নিম্নলিখিত রোগ থেকে মুক্ত থাকতে সহায়তা করে:

বয়স-সম্পর্কিত Macular Degeneration: বৃদ্ধ, প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে অন্ধত্বের একটি প্রধান কারণ।

হাম: একটি ভাইরাল সংক্রমণ যা এই ভিটামিন পর্যাপ্ত  গ্রহণের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা যেতে পারে।

ক্যান্সার প্রতিরোধে: যদিও এই ভিটামিন ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে পারে এমন কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই, কিছু গবেষণায় পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যে এটি ফুসফুসের ক্যান্সার এবং ত্বকের ক্যান্সারের মতো নির্দিষ্ট ধরণের ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সুরক্ষামূলক প্রভাব ফেলতে পারে।

Vitamin A এর ​​অভাবজনিত লক্ষণ ও উপসর্গঃ

এই Vitamin A এর ​​অভাবের কিছু লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা দেয়।  নিচে এগুলো দেওয়া হল:

  • কম আলোতে দেখতে অসুবিধা
  • শুকনো চোখ এবং অশ্রু তৈরিতে অসুবিধা
  • ত্বকের সমস্যা যেমন শুষ্ক, খসখসে এবং রুক্ষ ত্বক
  • দুর্বল ক্ষত নিরাময় এবং সংক্রমণের হার বৃদ্ধি।
  • এবং পরবর্তীতে এ লক্ষণগুলো  নিম্নোক্ত রোগে পরিণত হতে পারে: রাতকানা রোগ। 

Xerophthalmia (জেরোফথালমিয়া): শুষ্ক চোখ, কর্নিয়ার আলসার এবং অন্ধত্ব

ইমিউন সিস্টেমের কর্মহীনতা: রোগ সংক্রমণের সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। 

ত্বকের সমস্যা: শুষ্ক, আঁশযুক্ত এবং রুক্ষ ত্বক।


ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স | Vitamin B

ভিটামিন বি কমপ্লেক্স হল পানিতে দ্রবণীয় আটটি ভিটামিনের একটি গ্রুপ। এই ভিটামিনের গ্রুপটি সুন্দর স্বাস্থ্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বি কমপ্লেক্স পরিবারের ভিটামিনগুলি বিভিন্ন শরীরবৃত্তীয় ক্রিয়াকে সাহায্য করতে একসাথে কাজ করে। যেমন শক্তি বিপাক, কোষের বৃদ্ধি এবং লোহিত রক্তকণিকা উৎপাদন। এরা ভিটামিনের একটি গ্রুপ হওয়া সত্ত্বেও, তাদের অনুরূপ বৈশিষ্ট্য এবং কার্যকারিতার কারণে প্রায়শই তাদেরকে একত্রে ভিটামিন বি রূপে উল্লেখ করা হয়। 


ভিটামিন বি কমপ্লেক্স বা Vitamin B Complex  বলতে কি বুঝায়? 

ভিটামিন বি কমপ্লেক্স হল আটটি পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিনের একটি গ্রুপ যা শরীরের বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন মেটাবলিজম, ডিএনএ সংশ্লেষণ এবং লোহিত রক্তকণিকার উৎপাদন।

এই ভিটামিনের মধ্যে রয়েছেঃ 

  • Thiamin (B1)
  • Riboflavin (B2)
  • Niacin (B3)
  • Pantothenic acid (B5)
  • Pyridoxine (B6)
  • Biotin (B7)
  • Folate (B9)
  • Cobalamin (B12)

এই ভিটামিনগুলি শরীরে সঞ্চিত হয় না। শরীরে অতিরিক্ত প্রবেশ করলে প্রস্রাবের সাথে নির্গত হয়। এর কারনে খাদ্য বা সাপ্লিমেন্ট এর মাধ্যমে প্রতিদিন গ্রহণ করা অপরিহার্য।

ভিটামিন বি এর উৎস: 

এমন অনেক খাবার রয়েছে যাতে প্রচুর পরিমাণে বি ভিটামিন থাকে। নিচের খাবারগুলোতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি পাওয়া যায়:

বি ১: মটরশুঁটির, কলিজা, বাদাম, তাজা ফলমূল যেমনঃ কলা, কমলা ইত্যাদি 

বি ২: দুধ, ডিম, সেরিয়াল, টক দই, মাশরুম ইত্যাদি 

বি ৩: মাছ, গরুর মাংস, ডিম, ইত্যাদি 

বি ৫: গরুর মাংস, মুরগী, কলিজা, মাশরুম, ডিম, আভাকাডো ইত্যাদি 

বি ৬: পোলট্রি, মাছ, সয়াবিন ডাল, চিনাবাদাম, ওটস, কলা, দুধ ইত্যাদি 

বি ৭: ডিম, অর্গান মিট, মাছ, মাংস, বাদাম, মিষ্টি আলু

বি ৯: ব্রকলি, বাঁধাকপি, সবুজ শাকসবজি, কলিজা ইত্যাদি 

বি ১২: মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ইত্যাদি 

ভিটামিন বি কমপ্লেক্স এর কাজ:

এই ভিটামিন কমপ্লেক্স শরীরের বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপকে সমর্থন করতে সামঞ্জস্যপূর্ণ কাজ করে। উদাহরণ স্বরূপ:

  • থায়ামিন (B1) - খাদ্যকে শক্তিতে রূপান্তর করতে সাহায্য করে এবং স্নায়ুর কার্যকারিতায় সাহায্য করে।
  • Riboflavin (B2) - স্বাস্থ্যকর ত্বক, চোখ এবং স্নায়ুর কার্যকারিতা বজায় রাখতে ভূমিকা পালন করে।
  • নিয়াসিন (B3) - সুষ্ঠ প্রক্রিয়ায় হজম এবং ত্বককে সতেজ রাখে এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে ভূমিকা পালন করে।
  • প্যানটোথেনিক অ্যাসিড (B5) - শক্তি উৎপাদনে সাহায্য করে এবং হরমোন ও কোলেস্টেরল উৎপাদনে সহায়তা করে।
  • পাইরিডোক্সিন (B6) - নিউরোট্রান্সমিটার তৈরি করতে সাহায্য করে এবং ইমিউন সিস্টেমকে সাহায্য করে।
  • বায়োটিন (B7) - চর্বি, প্রোটিন এবং কার্বোহাইড্রেট বিপাক করতে সাহায্য করে এবং স্বাস্থ্যকর ত্বক, চুল এবং নখকে পেতে সাহায্য করে।
  • ফোলেট (B9) - ডিএনএ সংশ্লেষণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং লোহিত রক্তকণিকা উৎপাদনে ভূমিকা রাখে।

কোবালামিন (B12) - লোহিত রক্তকণিকা তৈরি করতে সাহায্য করে এবং স্নায়ুর কার্যকারিতা ধরে রাখে।


ভিটামিন বি কমপ্লেক্স এর উপকারিতা: 

  • ভিটামিন বি কমপ্লেক্স শরীরের অনেক উপকার করে, যার মধ্যে রয়েছে:
  • স্বাস্থ্যকর ত্বক, চুল এবং নখকে সুস্থ রাখে।
  • একটি সুস্থ ইমিউন সিস্টেম তৈরিতে ভূমিকা করে।
  • স্নায়ু তন্ত্রকে সাহায্য করে।
  • খাদ্যকে শক্তিতে রূপান্তর করতে ভূমিকা রাখে।
  • হজম প্রক্রিয়াকে সুষ্ঠভাবে পরিচালনা করে।
  • ডিএনএ সংশ্লেষণে ভূমিকা রাখে।
  • লোহিত রক্ত ​​কণিকা উৎপাদনে সাহায্য করে।

ভিটামিন বি কমপ্লেক্স সম্পর্কিত সম্ভাব্য সমস্যা:

যদিও Vitamin B Complex সাধারণত নিরাপদ, তবে গ্রুপের কিছু ভিটামিন অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহণ করলে সম্ভাব্য সমস্যা হতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ:

নিয়াসিন (B3) এর উচ্চ মাত্রা গ্রহণ করলে পেট খারাপ এবং লিভারের ক্ষতি হতে পারে।

বর্ধিত সময়ের জন্য উচ্চ মাত্রায় পাইরিডক্সিন (B6) গ্রহণ করলে স্নায়ুর ক্ষতি হতে পারে।

কোবালামিন (B12) উচ্চ মাত্রায় গ্রহণ করলে ডায়রিয়া এবং ত্বকে ফুসকুড়ি হতে পারে।

ঘাটতি জনিত সমস্যা বা লক্ষণ :

ভিটামিন বি এর ঘাটতি দেখা দিলে কিছু লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। নিচে এই লক্ষণগুলো দেওয়া হলো:

  1. চামড়ায় লাল লাল ফুসকুড়ি 
  2. মুখের চারপাশে ফাটল
  3. ঠোঁটে আঁশযুক্ত ত্বক
  4. জিহ্বা ফুলে যাওয়া
  5. ক্লান্তি
  6. দুর্বলতা
  7. রক্তাস্বল্পতা
  8. বিভ্রান্তি
  9. বিরক্তি বা বিষণ্নতা 
  10. বমি বমি ভাব
  11. পেটের বাধা
  12. ডায়রিয়া 
  13. কোষ্ঠকাঠিন্য
  14. পায়ে এবং হাতে অসাড়তা বা শিহরণ


ভিটামিন সি

 স্বাস্থ্যের জন্য খুব প্রয়োজনিয় এক পুষ্টি উপাদান। ইহা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করা থেকে শুরু করে হৃদরোগ, ত্বক কুচকে যাওয়া, গর্ভাবস্থায় শিশুর দেহ গঠন, চোখের স্বাস্থ্য সুরক্ষা – ইত্যাদির ক্ষেত্রে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ভিটামিন সি এন্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবেও কাজ করে। প্রাকৃতিকভাবে এই ভিটামিন বিভিন্ন খাদ্য যেমন ফলমুল ও শাক-সবজিতে প্রচুর পরিমানে পাওয়া যায়। খাদ্যে সাপ্লিমেন্ট হিসাবেও বাজারে সহজলভ্য রয়েছে।


এই ভিটামিনের অপর নাম এল-এসকরবিক এসিড। এই আর্টিকেলে ভিটামিন সি এর উপর বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করব। যেমন, দেহের জন্য ভিটামিন সি কেন প্রয়োজন, এর অভাবজনিত লক্ষণসমুহ, দৈনিক কতটুকু খেতে হয়, ভিটামিন সি এর উপকারিতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হবে।


ভিটামিন সি আমাদের কেন প্রয়োজন?

ইহা পানিতে দ্রবনীয় ভিটামিনের মধ্যে একটি ভিটামিন। মানুষ তার শরীরে এই ভিটামিন তৈরি করতে পারেনা। তাই আমাদের দেহে এর প্রয়োজনীয় মাত্রা বজায় রাখার জন্য দৈনিক বাহির থেকে খাদ্য ও সাপ্লিমেন্টের মাধ্যমে ইহা গ্রহণ করতে হয়।

আমাদের শরীর বিভিন্ন কাজে ভিটামিন সি ব্যবহার করে। তার কয়েকটি উদাহারণ-

ইহা আমাদের শরীরে কোলাজেন (collagen) নামে এক ধরণের প্রোটিন, এল- ক্যারোটিন (L-carotine) নামের এমাইনো এসিড এবং কিছু নিউরোট্র্যান্সমিটার তৈরিতে কাজ করে।

এন্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবে শরীরের বর্জ্য পদার্থ দেহ থেকে অপসারণে কাজ করে। এমন বর্জ পদার্থের একটি উদাহারন- reactive oxidative species, ROS.

দেহের ভিতর আয়রণ শোষণে ভূমিকা পালন করে।

ইহা দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সক্রিয় ও জোরদার করে।

দেহের ক্ষতস্থান মেরামতে কাজ করে।

ROS হল free radicals বা মুক্ত পরমানু যা দেহের কোষের ভিতর বিপাকীয় কার্যক্রম সংগঠিত হওয়ার পর বাই-প্রোডাক্ট হিসাবে তৈরি হয়। কোষের ভিতর বিপাক কার্য সম্পাদনের মাধ্যমে আমাদের শরীরে শক্তি উৎপাদন হয় যা সার্বক্ষণিকভাবে একটি চলমান প্রক্রিয়া। কারণ, খাদ্য গ্রহনের পর দেহে শক্তি উৎপাদন না হলে আমাদের বেচে থাকা সম্ভব নয়।

এই free radicals হল বিপাক কার্যের ফসল যা দেহের ভিতর oxidative stress তৈরি করে দেহে ক্যানসারসহ বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি তৈরি করে।

এছাড়া, আগেই উল্লেখ করা হয়েছে,  ভিটামিন সি যে কোলাজেন নামের প্রোটিন তৈরি করে। এই প্রোটিন দেহের যোজক কলার (connective tissues) প্রধান উপাদান এবং ইহা ১-২% পরিমানে মাংসপেশীর মধ্যে বিদ্যমান থাকে।

কোলাজেন দেহের ফাইব্রাস টিস্যু তৈরির প্রধান উপাদান। ফাইব্রাস টিস্যু দিয়ে দেহের ভিতর যা তৈরি হয় তা নিম্নরুপ-

টেনডন যা পায়ের গোড়ালির উপরের অংশে থাকে।

  • লিগামেন্ট
  • ত্বক
  • চোখের কর্নিয়া
  • কার্টিলেজ
  • দেহের হাঁড়
  • পরিপাক তন্ত্র
  • রক্ত নালী

ভিটামিন সি এর অভাবে কি হয়?

শরীরে ভিটামিন সি এর পরিমান কমে গেলে স্কার্ভি (scurvy) নামের রোগ হয়। এই রোগের অন্যতম লক্ষণ হল, শরীরে হাঁড়ের জয়েন্ট ফুলে যায়, দাতে মাড়ি থেকে রক্ত বের হয়, দাত নরম হয়, রক্তশূন্যতা দেখা দেয় এবং এক ধরণে ক্লান্তি অনুভব হয়।

ভিটামিন সি এর উৎস কি?

সাধারণত: ফলমুল ও শাক-সবজির মধ্যে এই ভিটামিন অধিক পরিমানে পাওয়া যায়।

যেসব ফলমুলে ইহা পাওয়া যায়-

লেবু,কমলা লেবু ও এর জুস,আঙ্গুর,কিউই (kiwi) ফল,আম,আনারস,তরমুজ,স্ট্রবেরি,পেপে,খরমুজ বা Cantaloupe,আমলকি

অপরদিকে যেসব সবজি এই ভিটামিন পাওয়া যায়-

কাঁচা মরিচ,ব্রোকলি,ফুলকপি ও পাতাকপি,পালন শাক ও অন্যান সবুজ পত্র বিশিষ্ট সবজি,মিষ্টি আলু ও গোল-আলু,টমেটো ও এর জুস,শালগম,মিষ্টি কুমড়া ও চাল কুমরা, ইত্যাদি।

এছাড়া, কিছু cereal জাতীয় খাদ্যেও ইহা পাওয়া যায়। অন্যান্য খাদ্য ও পানিয় এর মধ্যে অনেক সময় ভিটামিন সি fortify করা হয়। Fortify এর অর্থ হল যখন একটি খাদ্যের মধ্যে কোন ভিটামিন বা খনিজ লবন যোগ করা হয়, তাকে বুঝায়। কোন খাদ্য পণ্যের মোড়কে আপনি দেখতে পারেন সেখানে কি পরিমানে কোন প্রকারের ভিটামিন যোগ করা হয়েছে।


দৈনিক কতটুকু ভিটামিন সি খাওয়া প্রয়োজন?

যেকোন ভিটামিনের The Recommended Dietary Allowance (RDA) এর অর্থ হল দৈনিক ঐ ভিটামিন আপনার শরীরে দৈনিক কতটুকু প্রয়োজন হয় তা প্রকাশ করা।

কি পরিমানে ভিটামিন সি দৈনিক প্রয়োজন হতে পারে তা নির্ভর করে মানুষের বয়স এবং সেক্স এর উপর। অন্যান্য বিষয় যেমন গর্ভাবস্থা, অসুস্থতা ইত্যাদিও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।

ভিটামিন সি সহ অন্যান্য প্রয়োজনিয় ভিটামিনের দৈনিক চাহিদা পূরণে সর্বোত্তম পন্থা হল সুষম খাদ্য খাওয়ার অভ্যাস তৈরি করা যেখানে বিভিন্ন উৎসের সকল খাদ্য ও পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান থাকে।

নিচে ভিটামিন সি এর দৈনিক চাহিদা উল্লেখ করা হল:

Infants এর জন্য: সর্বোচ্চ মাত্রা:

জন্ম থেকে ৬ মাস বয়স হলে: দৈনিক ৪০ মিলিগ্রাম;

৭ থেকে ১২ মাস বয়স হলে: দৈনিক ৫০ মিলিগ্রাম;

শিশুদের জন্য:

১ থেকে ৩ বছর: দৈনিক ১৫ মিলিগ্রাম;

৪ থেকে ৮ বছর: দৈনিক ২৫ মিলিগ্রাম;

৯ থেকে ১৩ বছর: দৈনিক ৪৫ মিলিগ্রাম;

Adolescents:

১৪ থেকে ১৮ বয়সের মেয়ে: দৈনিক ৬৫ মিলিগ্রাম;

গর্ভবতি কিশোরি মেয়ে: দৈনিক ৮০ মিলিগ্রাম;

বুকের দুধ দানকারি কিশোরি: দৈনিক ১১৫ মিলিগ্রাম;

১৪ থেকে ১৮ বয়সের ছেলে: দৈনিক ৭৫ মিলিগ্রাম;


প্রাপ্ত বয়স্কের ক্ষেত্রে:

১৯ এবং তদুর্ধ বয়সের পুরষ: দৈনিক ৯০ মিলিগ্রাম;

১৯ এবং তদুর্ধ বয়সের মহিলা: দৈনিক ৭৫ মিলিগ্রাম;

গর্ভবতি মহিলা: দৈনিক ৮০ মিলিগ্রাম;

বুকের দুধ দানকারি মহিলা: দৈনিক ১২৫ মিলিগ্রাম

ধুমপায়িদের জন্য উপরে উল্লেখিত মাত্রার চেয়ে দৈনিক ৩৫ মিলিগ্রাম বেশি খেতে হবে।


ভিটামিন সি এর উপকারিতা কি?

ভিটামিন সি এর অনেক উপকারিতা আছে। তার মধ্যে গবেষণায় প্রমানিত এমন সাত ধরণের উপকার নিচে উল্লেখ করা হল।


১. জটিল দীর্ঘ মেয়াদি রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমিয়ে দেয়:

ইতোমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই ভিটামিন এক প্রকার শক্তিশালি এন্টিঅক্সিডেন্ট যা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাজ করে এবং হৃদরোগ ও ক্যানসারসহ অনেক জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা দুর করে।

২. হাই ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে কাজ করে:

গবেষণায় দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ উচ্চ রক্ত চাপে আক্রান্ত যা অনেক সময় স্ট্রোক ও হঠাৎ মৃত্যুর কারণ হয়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ভিটামিন সি হাই ব্লাড প্রেসার কমিয়ে আনতে ভূমিকা রাখে।

প্রাণির উপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, তাকে ভিটামিন সি সাপ্লিমেন্ট খাওয়ানোর ফলে তার রক্তনালী প্রসারন ঘটে। ফলে অধিক পরিমান রক্ত চলাচলের সুযোগ হয যা রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখার জন্য সহায়ক হয়।

৩. হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে কাজ করে:

বিশ্বব্যাপী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে চলছে। অনেক ফ্যাক্টর হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার জন্য দায়ী, যেমন- উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে উচ্চ মাত্রায় ট্রাই গ্লিসারাইডের উপস্থিতি, হাই কোলেস্টেরল ইত্যাদি। এই ফ্যাক্টরগুলি নিয়ন্ত্রণে কাজ করার বিষয়ে ভিটামিন সি এর সংশ্লিষ্টতার প্রমান বিভিন্ন গবেষণা ফলাফলে পাওয়া গিয়েছে।


৪. রক্তের ইউরিক এসিডের মাত্রা কমাতে কাজ করে:

রক্তে ইউরিক এসিডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার দ্বারা gout নামের একটি প্রতিরোধ করা যায়। Gout এমন এক রোগ যা দেহের অস্থিসন্ধিতে প্রদাহ তৈরি করে যার ফলে সেখানে খুব ব্যথার সৃষ্টি হয়। এই রোগের লক্ষণ তখন প্রকাশ পায় যখন রক্তে ইউরিক এসিডের মাত্রা খুব বেশী হয়। ইউরিক এসিড হল দেহে তৈরি হওয়া এক বর্জ্য পদার্থ। রক্তে যখন এর পরিমান বেড়ে যায় তখন তা দেহের অস্থি সন্ধিতে গিয়ে জমা হয় এবং সেখানে দানা বাধে। ফলে শরীরের ঐ জয়েন্টগুলিতে প্রদাহের সৃষ্টি হয় এবং এতে খুব ব্যথা পাওয়া যায়।

বিভিন্ন গবেষণা ফলাফলে ভিটামিন সি রক্তে ইউরিক এসিড কমাতে কাজ করে বলে প্রমান পাওয়া যায়।


৫. শরীরে আয়রণের অভাব প্রতিরোধে কাজ করে:

আমরা জানি আয়রন দেহের জন্য খুব প্রয়োজনীয় এক পুষ্টি উপাদান। যা লোহিত রক্ত কণিকা তৈরিতে এবং দেহের সর্বত্র অক্সিজেন সরবরাহে কাজ করে।

সাধারণত: উদ্ভিদজাত উৎসের আয়রণ আমাদের দেহে শোষণ হতে চায় না। আর, ভিটামিন সি উদ্ভিদজাত খাদ্যের মধ্যে বিদ্যমান আয়রন শোষনে সহায়তা করে। গবেষণায় দেখা যায়, ১০০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি খাওয়ার ফলে দেহে আয়রণ শোষণের হার ৬৭% এ উন্নীত হয়।

এভাবে ভিটামিন সি এনেমিয়া বা শরীরে রক্ত শূন্যতা দুরীকরণে ভূমিকা রাখে।

৬. দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করে:

শরীরের শ্বেত রক্ত কনিকার কাজ ত্বরান্বিত করার মাধ্যমে ইহা আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদারকরণে ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও, ত্বকের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এবং ক্ষতস্থান মেরামতে এর ভূমিকা আছে।

৭. বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে স্মৃতি শক্তি ধরে রাখাতে কাজ করে:

Dementia এক ব্যাপক অর্থ প্রকাশ করে যা চিন্তা চেতন ও স্মৃতি শক্তি কমে যাওয়ার সাথে সম্পর্কিত। সারা বিশ্বের প্রায় ৩৫ মিলিয়ন লোক বিশেষ করে যারা বয়স্ক তাদের অধিক হারে এই অবস্থার স্বীকার হতে দেখা যায়।

গবেষণা ফলাফলের সুপারীশ মতে, মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের বিভিন্ন অংশে oxidative stress ও প্রদাহ সৃষ্টির ফলে dementia অবস্থায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। ভিটামিন সি খুব শক্তিশালী প্রকারের এন্টি অক্সিডেন্ট হওয়ায় সেই ঝুঁকি দুর করতে সহায়তা করে।

উপরের উল্লেখিত উপকারিতাসমুহ গবেষণা ফলাফলে প্রমানিত। গবেষণায় প্রমানিত নয় ভিটামিন সি এর এমন কিছু উপকারিতা নিচে উল্লেখ করা হল-

দেহে সাধারণভাবে ঠান্ডা লাগার ক্ষেত্রে ইহা ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।

ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে ব্যবহৃত হয়।

চোখের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ব্যবহৃত হয়।

সীসা বিষক্রিয়ায় এটি কাজ করে বলে জানা যায়।


ভিটামিন 'ডি'

ভোজ্য তেল, দুগ্ধ ও দুগ্ধ জাতীয় খাদ্য, বিভিন্ন মাছের তেল, ডিমের কুসুম, মাখন, ঘি, চর্বি এবং ইলিশ মাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন 'ডি' পাওয়া যায়।

ভিটামিন 'ডি' কাজ

• অস্থি ও দাঁতের কাঠামো গঠন।

• অন্ত্রে ক্যালসিয়াম শোষণ বাড়ায় ।

• রক্ত প্রবাহে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।


অভাবজনিত রোগ 

ভিটামিন ‘ডি' এর অভাবে লোহার শোষণ, সঞ্চয় ও হিমোগ্লোবিন তৈরিতে বিঘ্ন ঘটে।

রিকেটস

রিকেটস রোগের লক্ষণ

   • ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়ামের অভাবে শিশুদের হাড় নরম হয়ে যায় এবং বৃদ্ধি ব্যাহত হয় ।

   • পায়ের হাড় ধনুকের মতো বেঁকে যায় এবং দেহের চাপে অন্যান্য হাড়গুলোও বেঁকে যায়।

   • হাত-পায়ের অস্থিসন্ধি বা গিট ফুলে যায়।

   • বুকের হাড় বা পাঁজরের হাড় বেঁকে যায়।

প্রতিকার

এ অবস্থায় ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

প্রতিরোধ

শিশুকে ভিটামিন ‘ডি' সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ানো উচিত। সূর্যরশ্মি থেকে ভিটামিন ডি পাওয়া যায়। তাই শিশুকে কিছুক্ষণের জন্য রৌদ্রে খেলাধুলা করতে দেওয়া উচিত।

অস্টিওম্যালেশিয়া

বয়স্কদের রিকেটস অস্টিওম্যালেশিয়া নামে পরিচিত। এই রোগের লক্ষণগুলো নিম্নরূপ –

   • ভিটামিন ‘ডি' এর অভাবে ক্যালসিয়াম শোষণে বিঘ্ন ঘটে।

   • ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের সঞ্চয় কমতে থাকে।

   • থাইরয়েড গ্রন্থির কাজের পরিবর্তন ঘটে।

   • অস্থি দুর্বল হয়ে অস্থির কাঠিন্য কমে যায় এবং হালকা আঘাতেই অস্থি ভেঙ্গে যাওয়ার অনেক বেশি থাকে।

প্রতিকার

উপরের লক্ষণগুলো দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। উপযুক্ত পরিমাণ ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন “ডি” যুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে উক্ত উপাদানগুলোর জন্য ঔষধ সেবন করা একান্ত জরুরি।

প্রতিরোধ

   • শিশুকাল থেকেই ভিটামিন 'ডি' ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া সুনিশ্চিত করতে হবে।

   • শিশুদেরকে কিছুক্ষণের জন্য রৌদ্রে খেলাধুলার ব্যবস্থা করতে হবে।


ভিটামিন ‘ই’

ভিটামিন ই এর কাজঃ

এটি আমাদের শরীরে তৈরিকৃত ফ্রি-রেডিক্যাল থেকে আমাদের শরীরকে রক্ষা করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই সকল ফ্রি-রেডিক্যাল তৈরিতেও বাধা প্রদান করে। এই সকল ফ্রি রেডিক্যাল আমাদের আর্টারিগুলোতে ক্লগ বা বাধা তৈরির অন্যতম কারন। একই সাথে এগুলো আমাদের ত্বক, দৃষ্টিশক্তিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। ভিটামিন ই এই ক্ষতিগুলো থেকে আমাদের রক্ষা করে। 

ভিটামিন ই আমাদের শরীরের নানারকমের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রতঙ্গ সচল রাখতে সাহায্য করে৷ একই সাথে এটি একপ্রকারের এন্টিঅক্সিডেন্ট অর্থাৎ এটি কোষকে সজীব রাখতে সহয়তা করে। এই কারনে নানা রকমের প্রসাধনীতে এর ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে৷ তবে প্রাকৃতিকভাবে আমরা যে vitamin E পেয়ে থাকি তা গঠনগত দিক থেকে কৃত্রিমভাবে প্রস্তুতকৃত প্রকরণ থেকে আলাদা, তবে এদের কার্যপ্রণালী প্রায় একই। 

নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পরিচালনা ছাড়াও এই ভিটামিন ব্যবহৃত হয় Vitamin E deficiency (ভিটামিন ই ডেফিসিয়েন্সি) এর চিকিৎসায়৷ যদিও এটি দুর্লভ কিন্তু জিনগত ত্রুটির জন্য এটি হতে পারে। এছাড়াও এলজাইমার ডিসিস, মিন্সট্রুয়াল ক্রাম্প, ইন্ট্রাক্রেনিয়াল হেমোরেজ সহ অনেক অসুখের প্রস্তাবিত চিকিৎসায় এটির ব্যবহার প্রচলন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। 

গঠন ও সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ

রাসায়নিক গঠনের দিক থেকে ভিটামিন ই মুলতঃ আট প্রকারের। এর ভিতরে রয়েছে চার রকমের টোকোফেরোল আর চার প্রকারের টোকোট্রাইনল। এদের মাঝে প্রথম প্রকরণ প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া যায় আর দ্বিতীয় প্রকরণ মুলতঃ কৃত্রিম উপায়ে প্রস্তুত করা হয়। রাসায়নিক গঠনে মিথাইল গ্রুপের অবস্থান অনুযায়ী এই প্রকরণগুলো হলো আলফা, বিটা, গামা ও ডেল্টা। 

১৯২২ সালে সর্বপ্রথম হার্বার্ট ম্যাকলিন ইভান্স এবং ক্যাথেরিন স্কট বিসপ ভিটামিন ই আবিষ্কার করেন। ১৯৩৫ সালে এটিকে সর্বপ্রথম আইসোলেশন করা সম্ভব হয়। এরপরে চলে যায় প্রায় পঞ্চাশ বছর। মানুষ এতটা সময় বুঝতে পারে নি এই প্রাণঅনুর গুরুত্ব। অবশেষে আর্টারি ক্লগিং এর সাথে এর যোগসূত্র পাওয়া যায় এবং মানুষ এর গুরুত্ব অনুধাবন করা শুরু করে। 

ভিটামিন ই এর উৎসঃ 

আমাদের প্রতিদিনের নানা রকম খাবারই আমাদের ভিটামিন ই এর সবচেয়ে বড় উৎস। যেমনঃ বিভিন্ন রকম ভোজ্যতেল। এর ভিতরে রয়েছে সয়াবিন তেল, সূর্যমুখী তেল, বাদাম তেল। ফল এর মাঝে আমলকী, আম, এভোকাডো, বিভিন্ন রকমের বাদাম ইত্যাদি ফলে অত্যাধিক পরিমানে Vitamin E আছে। সবজির ভিতরে কুমড়ো, পালং শাক, বিট ইত্যাদি উৎস হিসেবে বিবেচ্য। এছাড়া বিভিন্ন শারিরীক সমস্যায় ডাক্তারের পরামর্শে ভিটামিন ই ট্যাবলেট অথবা সাপ্লিমেন্ট নেওয়া হয়ে থাকে। 

Vitamin E ঘাটতি বুঝার উপায়

আগেই বলা হয়েছে Vitamin E চর্বিতে মিশতে পারে৷ এবং আমাদের শরীরে গ্রহণের এটিই একটি উপায়। যাদের শরীর চর্বি শোষণ করতে পারে না দেখা যায় তারা এই ভিটামিন ও শরীরে নিতে পারে না। আবার জিনগত সমস্যার কারনেও এই ধরনের সমস্যা দেখা যায়৷ এর কিছু লক্ষণ আছেঃ

রেটিনোপ্যাথি বা চোখের রেটিনায় সংক্রমন।

পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি অর্থাৎ পেরিফেরাল বা সহায়ক নার্ভাস সিস্টেমের ক্ষয়। যার ফলে হাত ও পায়ের পেশিতে ব্যাথা অনুভুত হয়। 

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া

এটাক্সিয়া বা চলাফেরা, নড়াচড়ায় নিয়ন্ত্রন না থাকা।


ভিটামিন ‘কে’

ভিটামিন কে বা Vitamin K কি?

ভিটামিন কে বা Vitamin K একটি Fat Soluble (চর্বি-দ্রবণীয়) ভিটামিন যা রক্ত ​​জমাট বাঁধা এবং হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যাবশ্যক। এটি প্রথম ১৯২৯ সালে আবিষ্কৃত হয়েছিল এবং "K" এসেছে জার্মান শব্দ "Koagulationsvitamin" থেকে, যার অর্থ “Clotting Vitamin” বা "জমাট বাঁধা ভিটামিন"। 


ভিটামিন কে এর প্রকারভেদ ;

এই ভিটামিন এর দুটি প্রধান প্রকার রয়েছে: 

Vitamin K1 (phylloquinone) এবং 

Vitamin K2 (menaquinone)

Vitamin K1 প্রাথমিকভাবে পাতাযুক্ত সবুজ শাকসবজি যেমন পালং শাক,পুঁই শাক,, লেটুসপাতা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ডিমের কুসুম, সয়াবিন তেল এবং যকৃতে ভিটামিন ‘কে’  এ পাওয়া যায়।

ভিটামিন K2 প্রাণী-ভিত্তিক খাবার এবং ফার্মেন্টেটেড খাবারে উপস্থিত থাকে। এছাড়া গাট ব্যাকটেরিয়াও ভিটামিন K2 এর বিশাল উৎস।


ভিটামিন কে এর স্বাস্থ্য উপকারিতা:

Vitamin K আমাদের শরীরে বিভিন্ন কাজ করার মাধ্যমে সাহায্য করে থাকে। নিচে গুরুত্বপুর্ণ তিনটি উপকারিতা দেওয়া হলো:

রক্ত জমাট বাঁধা: এই ভিটামিন এর প্রাথমিক ভূমিকা রক্ত ​​জমাট বাঁধতে সাহায্য করা। এটি প্রোটিনগুলিকে সক্রিয় করে যা রক্ত ​​​​জমাট বাঁধতে সাহায্য করে, অতিরিক্ত রক্তপাত রোধ করে।

হাড়ের স্বাস্থ্য: এই ভিটামিন হাড়ের বিপাক প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি হাড়ের স্বাস্থ্য এবং খনিজ সংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন তৈরি করতে সাহায্য করে, অস্টিওপরোসিসের ঝুঁকি কমায়।

হার্টের স্বাস্থ্য: Vitamin K হৃদরোগের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষামূলক প্রভাব ফেলতে পারে। এটি ধমনীতে ক্যালসিফিকেশন কমাতে সাহায্য করে, রক্ত ​​প্রবাহের উন্নতি করে এবং হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়।


ভিটামিন কে এর উৎস

পাতাযুক্ত সবুজ শাকসবজি: পুঁই শাক, পালং শাক, ব্রকলি এবং বাঁধাকপি ইত্যাদি ভিটামিন K1 এর চমৎকার উৎস।

প্রাণীজ খাবার: মুরগি মাংস, গরুর মাংস এবং ডিম ভিটামিন K2 এর ভালো উৎস।

ফার্মেন্টেটেড খাবার: দই, নাট্টো ইত্যাদি ভিটামিন K2 এর অন্যতম সেরা উৎস।


দৈনিক চাহিদা:

এই ভিটামিন এর প্রস্তাবিত দৈনিক গ্রহণ বয়স এবং লিঙ্গের উপর ভিত্তি করে পরিবর্তিত হয়। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য, দৈনিক গ্রহণ ৯০-১২০ মাইক্রোগ্রাম। গর্ভবতী এবং বুকের দুধ খাওয়ানো মহিলাদের বেশি পরিমাণে প্রয়োজন হতে পারে।

Vitamin K এর অভাব:

এই ভিটামিন-এর অভাব বিরল তবে Malabsorbtion Disorder, লিভারের রোগ বা নির্দিষ্ট ওষুধ গ্রহণকারী ব্যক্তিদের মধ্যে ঘটতে পারে। এই ভিটামিন-এর অভাবের লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে অত্যধিক রক্তপাত এবং ঘা। 

কাজ ;

   • দেহে ভিটামিন 'কে' প্রথ্রোম্বিন নামক প্রোটিন তৈরি করে।

   • প্রথ্রোম্বিন রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে।

অভাবজনিত সমস্যা ;

যকৃৎ থেকে পিত্তরস নিঃসৃত হয়। পিত্তরস নিঃসরণে অসুবিধা হলে ভিটামিন কে-এর শোষণ কমে যায়। ভিটামিন ‘কে’– এর অভাবে ত্বকের নিচে ও দেহাভ্যন্তরে যে রক্ত ক্ষরণ হয় তা বন্ধ করার ব্যবস্থা না নিলে রোগী মারা যেতে পারে। এই ভিটামিনের অভাবে অপারেশনের রোগীর রক্তক্ষরণ সহজে বন্ধ হতে চায় না। এতে রোগীর জীবন নাশের আশংকা বেশি থাকে।


ভিটামিন পি 

ভিটামিন পি-এর রাসায়নিক নাম হল: বায়োফ্ল্যাভোনয়েড (bioflavonoid)। এটি লেবু জাতীয় সকল ফলেই পাওয়া যায়।

ভিটামিন পি "এমন এক নাম যা একবার উদ্ভিদ-ভিত্তিক পদার্থের একটি গ্রুপকে আমরা এখন বায়োফ্ল্যাভোনয়েডস (যা একসময় ভিটামিন পি হিসাবে পরিচিত, উদ্ভিদ যৌগের একটি বৃহত শ্রেণীর যা গভীর রঙিন ফল, শাকসব্জী, কোকো, চা এবং ওয়াইন পাওয়া যায়) হিসাবে জানি যখন আপনি রঙিন উদ্ভিদ জাতীয় খাবারের সাথে সালাদ খাচ্ছেন, আপনি ভিটামিন পি এর একটি ডোজ পেয়ে যাচ্ছেন।


ভিটামিন পি উৎসঃ

সাইট্রাস ফল যেমন কমলা, লেবু ও ব্ল্যাকবেরি, স্ট্রবেরি এবং ব্লুবেরি যেমন লাল এবং নীল ফলগুলি ফ্ল্যাভ্যানোলের একটি চমৎকার উৎস যা এনথোকিয়ানিন নামে পরিচিত।

ব্ল্যাক টিতে ফ্ল্যাওয়েডস কেটচিন এবং কোরেসটিন রয়েছে যা ধমনী শক্ত করার বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করে

Post a Comment

Previous Post Next Post